সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ ব্যাটিং। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এসেও পাল্টায়নি টাইগারদের ব্যাটিংয়ের সেই চিত্র। টপ অর্ডার ব্যর্থতায় ৩৫ রান তুলতেই পাঁচ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সেঞ্চুরি করেছেন তাওহিদ হৃদয়। তার ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসে লড়াইয়ের পুঁজি পায় দল। অল্প পুঁজি নিয়েও ভালোই লড়াই করেছেন স্পিনাররা। তবে শেষ হাসিটা ভারতই হেসেছে।
দুবাইয়ে টস জিতে আগে ব্যাট করতে নেমে ৪৯ ওভার ৪ বলে ২২৮ রান তুলে অলআউট হয়েছে বাংলাদেশ। দলের হয়ে সর্বোচ্চ ১০০ রান করেছেন হৃদয়। তাছাড়া ফিফটি পেয়েছেন জাকের। ভারতের হয়ে ৫৩ রানে ৫ উইকেট শিকার করেছেন মোহাম্মদ শামি। জবাবে খেলতে নেমে ৪৬ ওভার ৩ বলে ৪ উইকেট হারিয়ে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় ভারত।
ব্যাটিংয়ের শুরুটা বাংলাদেশ যতটা খারাপ করেছিল, বোলিংয়ের শুরু হয়েছে তার চেয়েও খারাপ। নতুন বলেও ধারহীন ছিলেন তাসকিন আহমেদ-মুস্তাফিজুর রহমানরা। তাদের সাদা-মাটা বোলিংয়ের বিপক্ষে আক্রমণাত্মক শুরু করেন ভারতের দুই ওপেনার রোহিত শর্মা ও শুবমান গিল। তাতে ৮ ওভারেই দলীয় ফিফটি স্পর্শ করে ভারত।
শুরুর পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে এসে ইনিংসে প্রথমবার সাফল্যের দেখা পায় বাংলাদেশ। দশম ওভারের পঞ্চম বলটি অফ স্টাম্পের বাইরে ভালো লেংথে করেছিলেন তাসকিন। সেখানে উড়িয়ে মারতে গিয়ে টাইমিং করতে পারেননি রোহিত। তার ব্যাটের কানায় লেগে বল চলে যায় কভার পয়নেটের দিকে, সেখানে খানিকটা পেছনের দিকে সরে সহজ ক্যাচ নিয়েছনে রিশাদ।
রোহিত ফেরার পর ভারতের রানের লাগাম টেনে ধরেন রিশাদ হসেন-মেহেদি হাসান মিরাজরা। উইকেটে এসে শুরু থেকেই দেখে-শুনে খেলছিলেন বিরাট কোহলি। কিন্তু এই টপ অর্ডার ব্যাটার থিতু হয়েও ইনিংস বড় করতে পারলেন না। ইনিংসের ২৩তম ওভারে রিশাদের বলে স্লিপে দাঁড়িয়ে থাকা সৌম্যের হাতে সহজ ক্যাচ দিয়েছেন কোহলি। সাজঘরে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে এসেছে ৩৮ বলে ২২ রান।
সাম্প্রতিক সময়ে দুর্দান্ত ফর্মে আছেন শ্রেয়াস আইয়ার। তবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথম ম্যাচেই ব্যর্থ হলেন। চারে নেমে ১৫ রানের বেশি করতে পারেননি তিনি। এই মিডল অর্ডার ব্যাটারকে ফিরিয়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান। ২৮তম ওভারে ফিজের অফ-কাটার বুঝতে না পেরে বৃত্তের মধ্যেই ক্যাচ দিয়েছেন আইয়ার।
অক্ষর প্যাটেলকে রাহুলের আগে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিল ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট। পরিকল্পনা ছিল, দ্রুত রান তুলে দেবেন এই ব্যাটার। তবে সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ করেছেন রিশাদ। এই লেগিকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আকাশে বল তুলে দেন অক্ষর, ফিরতি ক্যাচ নিয়েছেন রিশাদ নিজেই। ৮ রান করে অক্ষর ফেরায় দেড়শর আগে চতুর্থ উইকেট হারায় ভারত। তাতে কিছুটা হলেও ম্যাচে ফেরে বাংলাদেশ।
এরপর রাহুলও দ্রুত ফিরতে পারতেন। থিতু হওয়ার আগেই ক্যাচ দিয়েছিলেন এই ব্যাটার। তবে জাকের আলি সেই সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেছেন। সেই সঙ্গে ম্যাচ থেকেও ছিটকে গেছে বাংলাদেশ। রাহুলের সঙ্গে গিলের অবিচ্ছিন্ন ৮৭ রানের জুটিতে আর কোনো বিপদ ছাড়াই জয়ের বন্দরে নোঙর করে ভারত। ১২৯ বলে অপরাজিত ১০১ রান করেছেন গিল। আর রাহুলের ব্যাট থেকে এসেছে অপরাজিত ৪১ রান।
বাংলাদেশের হয়ে ৩৮ রানে ২ উইকেট শিকার করেছেন রিশাদ। তাছাড়া একটি করে উইকেট পেয়েছেন তাসকিন আহমেদ ও মুস্তাফিজুর রহমান।
এর আগে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি বাংলাদেশের। ইনিংসের প্রথম ওভারেই সৌম্য সরকারকে হারায় টাইগাররা। ইনফর্ম এই ব্যাটার ৫ বল খেলেও রানের খাতা খুলতে পারেননি। মোহাম্মদ শামির করা ওভারের শেষ বলটি অফ স্টাম্পের বেশ খানিকটা বাইরে ছিল। সেখানে জায়গায় দাঁড়িয়ে ড্রাইভ করতে গিয়ে টাইমিং করতে পারেননি। ব্যাটের ভেতরের দিকের কানায় লেগে বল জমা পড়ে উইকেটরক্ষক লোকেশ রাহুলের গ্লাভসে।
প্রথম ওভারেই উইকেট হারানো বাংলাদেশ তাকিয়ে ছিল তিনে নামা শান্তর দিকে। তবে হতাশ করেছেন অধিনায়ক। সৌম্যের পথ ধরেই ডাক খেয়ে সাজঘরে ফিরেছেন তিনি। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে বোলিংয়ে এসেই সাফল্য পেয়েছেন হারষিত রানা। চতুর্থ বলটি আউটসুইং করেছিলেন এই পেসার, সেখানে কভার ড্রাইভ করতে গিয়ে শর্ট কভারে বিরাট কোহলির হাতে ধরা পড়েন শান্ত। ২ রানে ২ উইকেট হারানোর পর মেহেদি হাসান মিরাজকে নিয়ে জুটি গড়ার চেষ্টা করছিলেন তানজিদ তামিম। তবে চারে নেমে সুবিধা করতে পারলেন না মিরাজ। শামির করা সপ্তম ওভারের দ্বিতীয় বলটি অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে আরো বাইরে দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় কাট করতে গিয়ে স্লিপে শুবমান গিলের হাতে ধরা পড়েন মিরাজ। সাজঘরে ফেরার আগে ১০ বলে ৫ রান করেছেন তিনি।
অষ্টম ওভারে প্রথমবারের মতো স্পিন আক্রমণে যান রোহিত শর্মা। অক্ষর প্যাটেলের করা ওভারের দ্বিতীয় বলটি অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে সামান্য টার্ন করে বের হয়ে যাওয়ার সময় ড্রাইভ করতে যান তামিম। টাইমিং না হওয়ায় ব্যাটের কানা ছুঁয়ে রাহুলের হাতে ধরা পড়েন। ২৫ বলে ২৫ রান করেছেন এই ওপেনার।
তামিমের বিদায়ের পর উইকেটে আসেন মুশফিকুর রহিম। অভিজ্ঞ এই ব্যাটারের কাঁধে তখন পাহাড়সম দায়িত্ব। তবে মুশফিক দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলেন। নিজের খেলা প্রথম বলেই ডিফেন্স করতে গিয়ে এজ হয়ে রাহুলের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরেছেন। গোল্ডেন ডাক খেয়েছেন তিনি।
হ্যাটট্রিক বলটিও একই জায়গায় করেছিলেন অক্ষর। সেখানে মুশফিকের আউটের পুনরাবৃত্তি হতে পারতো আরেকবার। তবে রোহিত শর্মার কল্যাণে বেঁচে যান জাকের। তার ব্যাটের কানা ছুঁয়ে বল যায় প্রথম স্লিপে দাঁড়িয়ে থাকা রোহিতের হাতে, সহজ ক্যাচ রাখতে পারেননি ভারত অধিনায়ক। ফলে হ্যাটট্রিক বঞ্চিত হন অক্ষর।
৩৫ রান তুলতেই টপ অর্ডারের ৫ ব্যাটারকে হারিয়ে ধুঁকছিল বাংলাদেশ। দলের এমন বিপর্যয়ে হাল ধরেন জাকের আলি ও তাওহিদ হৃদয়। এই দুজনে মিলে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ১৫৪ রান যোগ করেছেন। যা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যেকোনো দলের ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। তাছাড়া বাংলাদেশের হয়ে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ষষ্ঠ উইকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডও এটি।
জাকের ৬৮ রান করে ফেরায় ভাঙে সেই রেকর্ড জুটি। এরপর উইকেটে এসে দুর্দান্ত এক ক্যামিওতে স্বপ্ন দেখান রিশাদ হোসেন। তবে ১২ বলে ১৮ রানের বেশি করতে পারেননি তিনি। রিশাদের পর তানজিম সাকিবও দ্রুত ফিরলে আবারো অলআউটের শঙ্কায় পড়ে বাংলাদেশ।
তবে তখনও এক প্রান্তে হৃদয় থাকায় কিছুটা হলেও আশা বেঁচে ছিল। তবে তার পায়ে ক্র্যাম্প হওয়ায় সেই আশাও ক্ষীন হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ব্যথা নিয়েই ব্যাটিং করেছেন এবং সেঞ্চুরিও স্পর্শ করেছেন। সবমিলিয়ে ১১৪ বলে তিন অঙ্ক ছুঁয়েছেন তিনি। শেষ ওভারে সাজঘরে ফেরার আগে ১১৮ বলে ১০০ রান এসেছে তার ব্যাট থেকে।
খুলনা গেজেট/এএজে